সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

রাজনীতির মূল্য পাঁচ টাকা !

প্রকাশিত: ১১:৪৪ এএম, জানুয়ারি ২১, ২০১৫
একুশে সংবাদ : রাজনৈতিক অবস্থা যখন খুব গরম- হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা ইত্যাদি নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত, তখন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে দিলেন, নতুন পাঁচ টাকার মুদ্রা বাজারে ছাড়া হবে। পুরনো এক ও দুই টাকার নোট এবং বাজার থেকে মুদ্রা তুলে নেয়া হবে। পাঁচ টাকার নোট হবে সর্বনিম্ন মুদ্রা! সচিবালয়ে ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি এ ঘোষণা দেন। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, এক ও দুই টাকার মুদ্রা সরকারের, তাতে অর্থসচিবের সই থাকে এবং পাঁচ থেকে এক হাজার টাকার মুদ্রাগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সই থাকে। সব ধরনের টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অর্থ হচ্ছে, এক ও দুই টাকা সরকারি মুদ্রা হলেও তা তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেই করার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানে না। এখন অর্থমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাঁচ টাকা সরকারি মুদ্রায় রূপান্তর করা হবে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এক ও দুই টাকার নোট এবং মুদ্রা বাজার থেকে পর্যায়ক্রমে তুলে নেয়া হবে এবং তা ধ্বংস করতে সরকারের খরচ হবে ৩০০ কোটি টাকা। এই এক ও দুই টাকার মুদ্রাকে তিনি জাদুঘরে পাঠাতে চান। অর্থমন্ত্রীর মতে, এই এক টাকা, দুই টাকা 'ইউজলেস' (অপ্রয়োজনীয়) টাকা নিয়ে মানুষকে ঘুরতে হয়। তিনি মানুষের উপকারের জন্যই তাহলে এ কাজ করছেন! খুব সুন্দর কথা। তাও ভালো, 'রাবিশ' বলেননি। তবে ভাগ্য ভালো। সকাল থেকেই তার কথা পাল্টে গেল। এক টাকা ও দুই টাকার নোট চলবে বলে জানিয়ে দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সোমবার সকালে আন্তর্জাতিক অটিজম ও অর্থোপেডিক সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কথা পাল্টালেন। তিনি বলেন, 'এক টাকা ও দুই টাকার নোট চলতে থাকবে।' এটুকু বলার পর আবারও বললেন, 'পর্যায়ক্রমে নোটগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে।' না, কথা সম্পূর্ণ পাল্টাননি। তার বিশ্বাসে অটল রয়েছেন, একটু চাপে পড়েই পাল্টে দিয়েছেন মাত্র। দেশে অনেক অর্থনীতিবিদ আছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়। তার প্রথম কারণ হচ্ছে, এক টাকা, দুই টাকা না থাকলে এবং পাঁচ টাকা সর্বনিম্ন মুদ্রা হলে কোনো পণ্যের মূল্য পাঁচ টাকার নিচে হবে না। ফলে শুধু শুধুই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে মুদ্রার কারণে। আর যে জিনিসের দাম ৫ থেকে ১০ টাকার মাঝামাঝি, তার মূল্য ঠিক হবে কী করে? কিংবা কিনলে বিক্রেতা কোন মুদ্রায় ফেরত দেবে? সাধারণ মানুষের কাছে এক টাকা, দুই টাকা- কোনোটাই কম নয়। অর্থমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্ত একেবারে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর আঘাত। দেশে যারা বিত্তবান, মন্ত্রী ও প্রভাবশালী আছেন, তাদের জন্য এক টাকা ও দুই টাকার নোট বিরক্তির কারণ হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের অর্থনীতি এখনও এক-দুই টাকার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখনও এক-দুই টাকায় কিংবা পাঁচ টাকার ওপরে বা দশ টাকার উপরে এক-দুই টাকা যোগ করে যা হয়, তাতে তাদের অনেক দৈনন্দিন জীবনের হিসাব হয়, যার খবর অর্থমন্ত্রীর হয়তো জানা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে যেসব মন্তব্য আসছে তা হচ্ছে এরকম- দিয়াশলাই বক্স দাম কত হবে? পাঁচ টাকা? নাকি এক ডজনের নিচে বিক্রি হবে না? আর বাসে কোনো দুই টাকার ভাড়াই থাকবে না- যত কাছেই নামুন। দেশের অনেক জায়গাতেই খেয়া পার হতে দুই টাকার বেশি নেয় না; সেখানে হুট করে পাঁচ টাকা হওয়াটা কীভাবে সমন্বয় হবে জানি না। শিশুরা লজেন্স কিনবে প্রতিবার পাঁচ টাকা দিয়ে? এভাবে হুট করে আমাদের উন্নতি হয়ে গেল? কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে। এক টাকা, দুই টাকা এখনও বহুল ব্যবহৃত মুদ্রা। অনেক পণ্য আর সেবার মূল্য এখনও এক টাকা আর দুই টাকায় পাওয়া যায়। পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে পাঁচ টাকা থেকে মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়েছে জানি না। আশপাশে তো দেখি না। আবার যাদের আমরা দক্ষিণা-টক্ষিণা দিই তাদেরও তো বেশ খুচরো পয়সা পকেটে রাখতে দেখি। এ মন্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনেক কথা আছে, যার সঙ্গে অর্থমন্ত্রী পরিচিত নন। তাই তার কাছে এ টাকা 'ইউজলেস'। অথচ ধনী দেশে শুধু এক-দুই টাকার মুদ্রা নয়, পয়সা পর্যন্ত চালু আছে। গরিব এবং নিম্নবিত্তদের জন্য এক-দুই টাকার মূল্য কত, তা অর্থমন্ত্রী বুঝতে অক্ষম হবেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি নিজে বিষয়টি ভালোভাবে তুলে ধরার জন্য আমার সহকর্মীদের সহায়তায় মুদির দোকান থেকে সাধারণ পণ্যের মূল্যের তালিকা নিয়ে দেখেছি, এক ও দুই টাকার মুদ্রা বাজারে না থাকলে কত নিত্যব্যবহার্য জিনিস কেনা যাবে না। গার্মেন্ট শ্রমিক ও অন্য শ্রমজীবী মানুষ যেখানে থাকেন এমন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা তথ্য থেকে জানা যায়, ম্যাচ, চকোলেট, লাড়ু, শ্যাম্পু, চুইংগাম, পানি এক টাকায় পাওয়া যায়। দুই টাকায় পাওয়া যায়, ম্যাচ, শ্যাম্পু, বিস্কুট, আচার, চকোলেটসহ প্রায় ১০ ধরনের পণ্য। পাঁচ টাকার উপরে দুই টাকা যোগ করলে ডিম পাওয়া যায় ৭ টাকায়। আবার ১০ টাকার উপরে দুই টাকার নোট একটি-দুইটি যোগ করে কাপড় কাচা সাবান ১২ টাকা, ১৪ টাকা, ১৬ টাকায় পাওয়া যায়। ২০ টাকার উপরে এক টাকা, দুই টাকা যোগ করে সাবান পাওয়া যায় ২৩ থেকে ৩০ টাকায়। রাস্তার ধারে ছোট দোকানে তিন থেকে সাত টাকায় কলা পাওয়া যায়। এর সঙ্গে রুটি সাত টাকা। এ খাবার দুপুরে রিকশাওয়ালা বা দিনমজুররা খেয়ে তখনকার মতো ক্ষুধা নিবারণ করেন। এভাবে পাঁচ টাকার সঙ্গে এক-দুই টাকা যোগ করে পাওয়া যায় চানাচুর ৬ থেকে ৩২ টাকা পর্যন্ত, চা তিন থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত, বাচ্চাদের আইসক্রিম এক থেকে শুরু করে ৩৫ টাকায় পাওয়া যায়। প্রসাধনী ১৪ থেকে ২৪ টাকা, কলম ৭ থেকে ১৭ টাকা। এটা সাধারণভাবে দোকান থেকে পাওয়া তথ্য; কোনো জরিপ নয়। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন হতে পারে। তবে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, পণ্যের মূল্য মোটেও পাঁচ-দশ টাকার মধ্যে সীমিত নেই, বরং এক-দুই টাকার ব্যবহারই অনেক বেশি। এ টাকা চালু না থাকলে গরিব মানুষের কেনাকাটা যেমন বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনি ছোট ব্যবসায়ীরাও বিক্রি না করতে পেরে শেষ হয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রী কথা পাল্টেছেন মনে হতে পারে; কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, একসময় এক-দুই টাকার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে। এর অর্থ কি দেশের উন্নতি হয়েছে? নাকি গায়ের জোরে তার সরকার মধ্যম আয়ের দেশ বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। আমি তো মনে করি, দেশের উন্নতি হয়েছে বুঝতে হবে যখন টাকার মূল্য এত বাড়বে, এক-দুই টাকায় অনেক জিনিস কেনা যাবে এবং এ মুদ্রার ব্যবহার আরও বাড়বে। আসলে আমাদের উচ্চপর্যায়ে যারা আছেন, তাদের কথার দাম কমে যাচ্ছে, সেটাই বাড়ানোর জন্য এক-দুই টাকা থেকে পাঁচ টাকা করছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির মূল্য এখন মানুষের জীবন, তাদের দুর্ভোগ। যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের দিক থেকে একটু দায়িত্বশীল আচরণ হলেই মানুষের জীবন বাঁচবে। যারা আন্দোলন করছেন তাদের দোষারোপ করে লাভ নেই। কারণ দাবি না মানা পর্যন্ত তাদের মাঠেই থাকতে হবে। আর মাঠে থাকতে গিয়ে জনগণের ওপর ভোগান্তি হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে হলে সরকারেরই এগিয়ে আসতে হবে। দমন-পীড়ন করে নয়, সমঝোতার মাধ্যমে। সবকিছুর উপরে হতে হবে দেশের মানুষের স্বার্থ। রাজনীতির মূল্য পাঁচ টাকা নয়, মানুষের সুখ-শান্তি। সেটাই যেন আমরা পাই। ফরিদা আখতার : নারীনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২১-০১-০১৫:

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1