সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

হেমন্তের বিকেলে পদ্মায় একদিন

প্রকাশিত: ০২:৩২ পিএম, ডিসেম্বর ২১, ২০১৪
একুশে সংবাদ : হেমন্তের এক বিকেলে দল বেঁধে পদ্মায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার মনটাকে এখনও আবিষ্ট করে রাখে। নৌকায় ভাসতে ভাসতে গ্রামীণ নিসর্গদৃশ্য মননে, অনুভবে আজও ঢেউ তোলে। গালিচার মতো বিছিয়ে থাকা আদিগন্ত চর, গাছ-গাছালি ও শ্যামল প্রকৃতির ব্যাঞ্জনা ভেতরটাকে নাড়া দেয়। দক্ষিণায়নের দিনে নদী ভ্রমণ আর সূর্যাস্ত দেখার কথা অনেকেরই খেয়াল থাকে না। যাদের থাকে তারাও যে সব সময় অবসর করে উঠতে পারেন এমন নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ থাকেন যারা এ সময় দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকেন। আবার অনেকে ঘুরে আসেন কাছেপিঠে কোথাও থেকে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলার মানুষ পাকশীতে এ সময় বেশি আসেন। আনন্দদায়ক নদী ভ্রমণ মানেই পদ্মা। পাকশীর পদ্মা সত্যিই অন্যরকম; শূন্যতা ভুলিয়ে দেওয়ার মতো। কিন্তু আসলেই কী তাই? পাকশীর নদীতটে বেড়াতে বেড়াতে মনে হবে ‘শেষ হইয়াও বুঝি হইল না শেষ’। কিছু কি অপূর্ণ থেকে গেল? আসলে এখানে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সফরের চল আছে। বেশির ভাগ ভ্রমণপিপাসু যদিও সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরেন। ফলে তারা রাতের পাকশীর রূপ দর্শন থেকে বঞ্চিত হন। পদ্মায় সূর্যের ডুব দেওয়া আর জেগে ওঠার দৃশ্য দেখারও তেমন পর্যটক নেই। যারা এখানে আসেন তারা সকালে এসে বিকেলেই ফিরে যান। প্রাক সন্ধ্যার পশ্চিমাকাশ, ভাসমান বৈঠার নৌকা দেখা আর ঝিরঝিরে হাওয়া অনুভব করার মতো সমাহিত সন্ধ্যায় নির্জন নদী তীরের কুপি বাতি জ্বালা দৃশ্য দুচোখে বিমূর্ত হয়ে ওঠে। হেমন্তের পদ্মা স্থির। ফলে নির্ভয়ে নৌভ্রমণ করা যায়। পানির গভীরতাও কম থাকে। দীর্ঘ ইস্পাত সেতুর জাফরি কাটা ছায়া পড়ে পদ্মার স্বচ্ছ পানিতে। থেকে থেকে দোল খায়। কচি কচি ঢেউ ওঠে। অন্যান্য ঋতুতে ঢেউ বেশি থাকে বলে ছায়ার আল্পনা স্পষ্ট হয় না। কিন্তু এ সময় কয়েক ফুট তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। আহা! পদ্মা! এই পানিতে গা ধুয়ে পরিচ্ছন্ন অনুভব করি। ঘণ্টায় তিনশ’ টাকা নৌকা ভাড়া। দলে লোক বেশি থাকলে এ অংক গায়ে লাগে না। সাঁঝ বেলার ফিকে আলোর মহিমা ছুঁয়ে চলে যায় জীবনের সীমা। স্থান ভেদে উত্থান ঘটে ধোঁয়াশার। বাড়ে অনুভব শক্তি। কৌতূহলপ্রবণ মনটা খানিক পরিতৃপ্ত হয়। পাকশী ঘাট থেকে ডিঙি নৌকা ঘণ্টা অনুযায়ী মিটিয়ে যাত্রা শুরু করি। প্রথমে ভাটির দিকে। ডানে গড়াই নদীর মুখ। তারপর উজানের দিকে যাওয়া। সাত আট কিলোমিটার যাওয়ার পর ডানে সারাঘাট, বামে গোলাপনগর, দামুকদিয়া। যেতে যেতে উত্তরের হাওয়া অনেক সময় শীত ধরিয়ে দেয়। পদ্মা পাবনা জেলায় দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা দিয়ে ৯০ কিলোমিটার প্রবাহিত। বেশ প্রশস্ত নদী। আগে এ নদীতে বছরের সকল সময়েই নাব্যতা থাকত। এখন ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমের আগেই শুকিয়ে যায়। থাকে না স্রোতধারা। জেগে ওঠে বালিয়াড়ি। চৈত্রে ওড়ে ধুলো। তাই বসন্তের চেয়ে হেমন্তেই নৌভ্রমণটা উপভোগ্য হয়। পদ্মা নদীর দুই তীরে রয়েছে পানি পরিমাপের গেজ যা ব্রিটিশ আমলেও ছিল। এটা দেখেই বাংলাদেশ ও ভারতের পানি বিশেষজ্ঞরা প্রাপ্ত পানির কিউসেক হিসেব করেন। ভাসতে ভাসতে এসব মনে পড়ে। ভ্রমণ সাহিত্যে ‘হিমালয় যাত্রা’ বলে স্বতন্ত্র একটা ব্যাপার আছে। পদ্মা নদীর বুকে নৌভ্রমণও আমার কাছে একই ব্যাপার মনে হয়। কেবল নদী পথ সংকুচিত হওয়ায় এবং সুবিধা না থাকায় ভ্রমণ ধারা অব্যাহত নেই। শহর থেকে একটু গাঁয়ের দিকে গেলেই টের পাওয়া যায় হেমন্তের সঞ্চার। ঋতুসন্ধির এই কালে এক দিকে জ্বলে রাতের আকাশ প্রদীপ অপরদিকে দিনের ঝলমলে রোদ। আর মেঘের চালচিত্র প্রকৃতির সবুজাভা ছড়িয়ে থাকে বিকেলের মাঠে মাঠে। অমৃতময় সন্ধ্যা কখনো কখনো ঢাকা পড়ে হাল্কা কুয়াশায়। এ ঋতুতে আকাশ থাকে নীল, থাকে সেখানে মেঘের আনাগোনা। পরিবেশ থাকে অনুকূলে। তাই ভ্রমণে সুখ পাওয়া যায়। পাকশীতে সন্ধ্যা রাতে ঘাসে ঢাকা ঝোঁপ-ঝাড় থেকে ভেসে আসা একটানা ঝিঁঝির ডাক আর জোনাকীর আলো মায়া ধরিয়ে দেয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে হেমন্ত স্বতন্ত্র ঋতু নয়- শরতেরই অংশ। তারপরেও কার্তিক, অগ্রহায়ণের আকাশ তারায় তারায় ভরে যায়। তারা চেনার উপযুক্ত কালের নাম এই হেমন্ত। একসঙ্গে আকাশের যত বেশি অংশ দেখা যায় ততই তারা চেনার সুবিধা। হেমন্তের আকাশে সন্ধ্যায় জেগে ওঠে নক্ষত্রমণ্ডল। এ সময় তারা চেনা থাকলে আকাশ দেখতে মন্দ লাগে না। পূর্ণিমা রাতের পদ্মা অন্যরকম। মনে আলাদা অনুভূতি সঞ্চারিত হয়। এক টুকরো মেঘ এসে জ্যোৎস্না ঢেকে দিলে জোড়াসেতুকে তখন আবছা আঁধার ঢেকে ফেলে। তাতে কল্পনায় বিচিত্র রূপ ফুটে ওঠে। যদিও সেই রূপ দেখার লোকের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। তারপরও পেপার মিলের পাম্পিং স্টেশনের কাছে গোল চত্বরে অনেককেই বসে থাকতে দেখা যায়। নির্জনতায় কয়েকটি প্রহর কাটিয়ে যান পর্যটকেরা। আসলে রূপসী পাকশী যেন একেক ঋতুতে একেক রকম রূপটান মেখে বসে থাকা রমণী। পদ্মার নিস্তরঙ্গ মেজাজ অনুভব করা যায় হেমন্ত ও শীতকালে। এ সময় পানিতে টান ধরা রেখা দেখা যায়, পানির রাগ থাকে না। বর্ষায় নদীর মাঝে প্রবল স্রোতে নাভি সৃষ্টি হয়- যা দেখে ভয় লাগে। হেমন্তের হাওয়ায় বিকেলে পদ্মার বুকে নৌকা ভ্রমণ মানেই পাকশী। জোড়াসেতুর ভেতর দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যেতে হয়। ছুটির দিনে এখানে অবকাশ যাপন মন্দ লাগে না। আজকের দিনে অনেকের সাথেই পদ্মা নদীর পরিচয় বা সাক্ষাত হয়। ট্রেনযাত্রী হয়ে হার্ডিঞ্জ সেতু পেরিয়ে বা লালন শাহ্ সেতু থেকে যানবাহনে চেপে যেতে যেতে এক ঝলক নদী ও সেতু দেখা হয়ে যায়। অবশ্য ভাড়াটে নৌকায় বসে উজানে বা ভাটিতে ভেসে যাওয়ার সময় পদ্মার পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুই তীর প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। নদীতে আগের মতো আর রকমারি নৌকার চলাচল নেই। লঞ্চ বা ফেরিও চলে না। অথচ এক সময় অসংখ্য নৌযান চলাচল করত। ২০০৪-এর ১৭ মে পর্যন্ত ফেরিও চলেছে। লালন শাহ্ সেতু চালুর পর এখন আর নদীর বুকে ব্যস্ততা নেই। কেবল গোটা কতক ডিঙি নিয়ে জেলেরা মাছ শিকারে ভাসে। যদি আকাশের দিকে দৃষ্টি তোলা যায়, তাহলে খানিক দার্শনিক ভাব আসে বিস্ময়কর সৌন্দর্যের চমকে। দিগন্তের ফিকে নীলে থোকা থোকা মেঘ ভেসে যায়। হেমন্তের দিনান্তবেলায় আকাশে তেমন রঙিন মেঘের সমাগম ঘটে না। হেমন্তের আকাশ যেন সূবর্ণবৎ জোড়াসেতুকে গাঢ় আলিঙ্গনের জন্য মেঘাবরণ হতে ছায়ার আঁচল ছড়িয়ে দেয়। নিসর্গের মেঘমাত্রিক সৌন্দর্য ইতিহাস, অভিজ্ঞতা মিলে পাকশী অনুভবযোগ্য স্থান। হেমন্তে পদ্মার মৌনতা অনেকেরই অদেখা। কেউ হয়তো একাধিকবার দেখেছেন। পদ্মার বুকে সূর্য বলের মতো লাফিয়ে উঠে দিগন্তে ডুবে যায় না। কেবল গড়িয়ে যায়। নৌকার ছই ও গলুই ছুঁয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আঁধার ঘনিয়ে আসে। যে জীবনে আনন্দ নেই, বিনোদন নেই, সে জীবন নিয়ে নৌকায় ভাসলেই ভালো লাগা জেগে ওঠে মনে। যারা ভ্রমণবিলাসী তারা পুলকিত হন। কিন্তু আরো দেখার বাসনাই পর্যটকের মনে অসন্তোষের বীজ বোনে। আসলে তৃষ্ণা থাকলে এক গ্লাস পানি অমৃতের মতো লাগে। পিপাসা না থাকলে পানি পানের তৃপ্তি থাকে না। তেমনি ভ্রমণ সুখ। পাকশী সম্পর্কে অনেকেরই কৌতূহল আছে। এটা স্বাভাবিক। অনেক পর্যটক, গবেষক, ঐতিহাসিক ও সাংবাদিক পাকশীতে পা রেখেছেন একাধিকবার। এখানকার পরিবেশটাও কবি-সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণা যোগায়। একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২১-১২-০১৪:

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1