সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি রানীখং

প্রকাশিত: ০৪:০৮ পিএম, অক্টোবর ২৯, ২০১৪
একুশে সংবাদ : গারো পাহাড়, সীমান্ত এলাকার ঐতিহ্য আর প্রকৃতির সংমিশ্রণে এক অপরূপ লীলাভূমি। সারি সারি পাহাড়, টিলা, পাহাড়ের স্তরে স্তরে লুকিয়ে থাকা নানা রঙের চিনামাটি, ঝরনার মতো বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ জলধারা, সিলিকা বালির আদিগন্ত বিস্তৃত চরাচর, এবং বনভূমির পাশাপাশি সুসং রাজবাড়ি, কমলরানীর দিঘি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক একাডেমি, হাজং মাতা রাশিমণির স্মৃতিসৌধ, কমরেড মণিসিংহের স্মৃতিবিজড়িত টংক শহীদ স্মৃতিসৌধসহ নানা কিংবদন্তিতে সমৃদ্ধ এই জনপদ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গারো, হাজং, হদি, কোচসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। নেত্রকোনা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ পাহাড়ি জনপদের আরেকটি আকর্ষণ রানীখং টিলা এবং এর ওপর নির্মিত শত বছরের প্রাচীন রানীখং মিশন। সোমেশ্বরীর কূল ঘেঁষে স্থাপিত এ মিশনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ক্যাথলিক ধর্মপল্লী। স্থানীয়ভাবে এটি ‘সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী’ নামে পরিচিত। ভারত সীমান্ত ঘেঁষে নান্দনিক কারুকার্যে নির্মিত এই ক্যাথলিক মিশন একটি দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যান সেখানে। প্রকৃতি আর ইতিহাস সেখানে সযত্নে রয়েছে একসঙ্গে। ‘রানীখং’ নামকরণের নেপথ্যেও রয়েছে নানা ইতিহাস। এটি মূলত পাহাড়ি টিলার নাম। কথিত আছে, এক সময় এই জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলটিতে ‘খংরানী’ নামে এক রাক্ষুসী ছিল। গারো আদিবাসীরা তাকে পরাস্ত করে সেখানে জনবসতি গড়েন। খংরাণীর নামানুসারেই জায়গাটির নাম রাখা হয় রানীখং। তবে এই ইতিহাসের স্বপক্ষে যুক্তি নেই। নামকরণ যে ভাবে বা যে কারণেই হোক না কেন এর ‘রাণী’ শব্দটির প্রয়োগ যথার্থ ও স্বার্থক। কেননা এই অঞ্চল সত্যিই সৌন্দর্যের রানী। গারো পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য যে কোনো আগন্তুকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। পরিচয় করিয়ে দেয় নতুন এক পৃথিবীর সঙ্গে। রানীখং মিশন ও ক্যাথলিক গীর্জা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। যদিও এর আগে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ময়মনসিংহ অঞ্চলে খ্রিস্টের বাণী প্রচারিত হতে থাকে। কিন্তু দুর্গাপুরে এর সূচনা হয় আরও অনেক পরে, বিশ শতকের শুরুতে। তখনও পর্যন্ত এ অঞ্চলের পাহাড়ি জনপদে বসবাসরত গারো-হাজংরা তাদের নিজস্ব ধর্মরীতি বিশ্বাস করত। জানা গেছে, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সুসং দুর্গাপুরের টাকশালপাড়া গ্রামের পাঁচ সদস্যের একটি আদিবাসী প্রতিনিধি দল ঢাকা ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ হার্থের সঙ্গে দেখা করে তাদের এলাকায় মিশনারী যাজক পাঠানোর অনুরোধ জানান। বিশপ হার্থ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা ত্যাগ করার সময় তাদের জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ ও গারো অঞ্চলে মিশনারী প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। এরপর ধর্মপালের দায়িত্ব নেন লিনেবর্ণ। তিনি এডলফ্ ফ্রান্সিস নামে একজন ফাদারকে দুর্গাপুরের টাকশাল পাড়ায় যীশুর বাণী ও ধর্ম প্রচারের জন্য পাঠান। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ একদল গারো নারী-পুরুষকে বাপ্তিষ্ম প্রদানের মধ্য দিয়ে তিনি প্রচার কাজের সূচনা করেন। এরাই পৃথিবীর প্রথম ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত গারো সম্প্রদায়। প্রথম চার বছর টাকশালপাড়া থেকেই অস্থায়ীভাবে ধর্ম প্রচারের কাজ চালানো হয়। এরপর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সুসং এর জমিদারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়ে রানীখং টিলায় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় মিশন ও ক্যাথলিক গীর্জা। এটিই ‘সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী’। বর্তমানে এখানে ফাদারের দায়িত্বে আছেন ফাদার যোশেফ। প্রায় আট হাজার বিশ্বাসী ভক্তকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই ধর্মপল্লীর অধীনে পরিচালিত হচ্ছে ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি উচ্চ বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, বড় গীর্জাসহ ৪০টি ছোট গীর্জা। সমতল থেকে বেশ উঁচু রানীখং টিলা। টিলার দক্ষিণ দিকে দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার পেড়িয়ে একটু এগুলেই চোখে পড়বে ধর্মপাল বিশপ হার্থসহ পাঁচ গারো হাজং আদিবাসীর মূর্তিসংবলিত একটি নান্দনিক ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের ডানদিকে একটি ফলকে লিখে রাখা হয়েছে ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। ভাস্কর্যের ঠিক পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে খ্রিস্টের মূর্তি। এখান থেকে একটু দূরের একটি কক্ষে সাধু যোসেফের মূর্তিও রয়েছে। এর বাম পাশে শত বছরের প্রাচীন ক্যাথলিক গীর্জা। পাঁচটি চূড়াসহ গীর্জাটির স্থাপত্যশৈলী অনন্য; মার্বেল পাথরের কারুকার্যশোভিত। গীর্জার সামনের পথ দিয়ে ওপরের দিকে এগুলে দেখা যাবে বিশ্রামাগার এবং মিশন পরিচালিত বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের পৃথক হোস্টেল। সবকিছু সাজানো-গোছানো, ছিমছাম। দেখে মনে হবে, পুরো এলাকাটিই যেন সুসজ্জিত বাগান। জায়গাটি দেশি-বিদেশি নানা ফুল-ফল ও বনজ গাছে পরিপূর্ণ। টিলার পূর্বপাশে দাঁড়িয়ে একটু নিচে তাকালেই সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ জলধারা বয়ে যেতে দেখা যায়। উত্তরের গারো পাহাড় থেকে ঝরনার মতো নেমে আসা এ নদীটির আদি নাম ‘সিমসাঙ্গ’। পরে সুসং রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সোমেশ্বর পাঠকের নামানুসারে এর নাম হয় ‘সোমেশ্বরী’। নদীর স্বচ্ছ জলধারার নিচ দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় সিলিকা বালিকণা। নজর কেড়ে নেয় বালিকণার নিচ থেকে আদিবাসী নারী-পুরুষদের পাহাড়ি কয়লা এবং কাঠ সংগ্রহের দৃশ্য। ওপরের নীল আকাশও খুব কাছাকাছি মনে হয় রাণীখং টিলায় দাঁড়ালে। উত্তর পাশে চোখ মেললে হাতছানি দেয় ভারত সীমান্তে অবস্থিত মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড় সারি, অরণ্য, পাহাড়ের মাঝখান থেকে উঁকি মেরে থাকা আদিবাসীদের বাড়িঘর। রানীখং-এ গেলে শুধু টিলার সৌন্দর্য নয়, অবলোকন করা যায় আশপাশের আরও মনোমুগ্ধকর অনেক কিছু। যাত্রার শুরুতেই দুর্গাপুরের প্রবেশপথে বিরিশিরি এলাকায় দেখা যাবে স্থানীয় আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র- ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক একাডেমি, এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বেশ কয়েকটি গীর্জা। দুর্গাপুর শহরে রয়েছে সুসং রাজবাড়ি, নানান নিদর্শন ও কমরেড মণি সিংয়ের স্মৃতিবিজড়িত টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। সোমেশ্বরী পাড় হয়ে রানীখং-এর পথ ধরে যেতে যেতে দেখা যাবে কুল্লাগড়া গ্রামে রামকৃষ্ণ মঠ এবং বহেরাতলি গ্রামের হাজং মাতা রাশিমণির স্মৃতিসৌধ। ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত তীর-ধনুক আকৃতির স্মৃতিসৌধটি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে জানান দেয়। এছাড়াও রানীখং এর সামান্য উত্তর দিকে বিজয়পুর। এখানকার সাদা চিনামাটি বিখ্যাত। এই মাটি দিয়েই তৈরি হয় সিরামিকের জিনিসপত্র। যাবেন যেভাবে : ঢাকা থেকে দুর্গাপুরের দূরত্ব ১৭০ কি.মি.। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে দুর্গাপুরের বিরিশিরি পর্যন্ত সরাসরি বাস চলে। দুর্গাপুর থেকে রানীখং-এর দূরত্ব পাঁচ কি.মি.। রাতে থাকার জন্য বিরিশিরিতে রয়েছে দুটি এনজিও পরিচালিত গেস্টহাউস। এ ছাড়াও রয়েছে নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক একাডেমির রেস্টহাউস এবং সরকারি ডাকবাংলো। সম্প্রতি ‘আমাদের বাড়ি’ নামে একটি প্রাইভেট রিসোর্টও গড়ে উঠেছে রানীখং সংলগ্ন শশারপাড় গ্রামে। তবে এগুলো আগেই বুকিং দিতে হয়। দুর্গাপুর সদরে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে যেখানে আপনি ভালো মানের খাবার পারবেন। একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৯-১০-০১৪:

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1