সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

নারীকণ্ঠে প্রথম মাইজভান্ডারি গান

প্রকাশিত: ০৬:০৬ এএম, অক্টোবর ১৯, ২০১৪
একুশে সংবাদ : ‘দেখে যা রে মাইজভান্ডারে/ হইতেছে নূরের খেলা/ নূরি মওলা বসাইল প্রেমের মেলা’—নারীকণ্ঠে প্রথম মাইজভান্ডারি গান। ভাঙল দীর্ঘদিনের রীতিও, দরবারের বাইরে এল এই মরমি সংগীত। গ্রামোফোনের রেকর্ডে সেই গান ছড়িয়ে পড়ল চট্টগ্রামের আনাচকানাচে। ভক্তিভরে গ্রহণ করল সাধারণ মানুষ। কিন্তু কেউ কেউ প্রশ্ন তুলল, দরবারি গান বাইরে কেন? তবে হৃদয়কাড়া সুরের কাছে ধোপে টিকল না কোনো কিছুই। একে একে বের হতে থাকল মাইজভান্ডারি গানের অ্যালবাম। সেই নারীকণ্ঠ, সেই আবেগ। এর পরের গল্প তো সুরের আরাধনায় শ্রোতার মন জয়ের। শুধুই কি মাইজভান্ডারি, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানেও পোক্ত অবস্থান তাঁর। শ্রোতাদের মন কেড়ে নেওয়া ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ (গীতিকার আবদুল গফুর হালী) গানটিও যে প্রথম তাঁর গাওয়া। তিনি কল্যাণী ঘোষ। মাইজভান্ডারি ও আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শিল্পী। পার করছেন শিল্পীজীবনের চার দশক। পেরিয়েছেন নানা চড়াই-উতরাই। সদরঘাট পোস্ট অফিস গলি ৯ অক্টোবর। বিকেল চারটা। সদরঘাটের পোস্ট অফিস গলির হাজী ভবনের পাঁচতলায় বেল টিপতেই বেরিয়ে এলেন অভিজিৎ চক্রবর্তী (প্রখ্যাত তবলাবাদক ও কল্যাণী ঘোষের স্বামী)। হাসিমুখে অভ্যর্থনা দিয়ে বসালেন বসার ঘরে। কক্ষটি ঠাসা গুণী দুই শিল্পীর বিভিন্ন সময় পাওয়া ভালোবাসার স্মারকে। শোকেসে থরে থরে সাজানো অসংখ্য ক্রেস্ট। সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতেই অভিজিৎ চক্রবর্তী বললেন, আরও আছে ভেতরের ঘরে। ক্রেস্ট রাখার জায়গা হয় না। এক ফাঁকে ভেতরের কক্ষের পর্দা তুলে হাঁক দিলেন, ‘তোমার হলো, ওনারা বসে আছেন।’ ভেতর থেকে ডাক এল, ‘আসছি।’ কয়েক মিনিট পর যোগ দিলেন কল্যাণী ঘোষ। সাদামাটা মানুষটির মুখে লেগে আছে হাসি। কীভাবে রাঙ্গুনিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েটি জয় করল বিপুল শ্রোতার মন? কল্যাণী খুললেন স্মৃতির ডালি। ফিরে গেলেন পুরোনো দিনে। শ্যামের হাত ধরে, হালীর স্নেহে ঘটনাটা আশি সালের। গানের বায়না নিয়ে রাঙ্গুনিয়ার খীলমোগলে গেলেন শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। আঞ্চলিক গানের সম্রাট এল, সাড়া পড়ে গেল গ্রামে। জমজমাট অনুষ্ঠান শেষে শ্যামসুন্দরের হাত ধরল ১১ বছরের কল্যাণী ঘোষ। বলল, ‘আমাকে আপনার সঙ্গে নিতে হবে। আমি গান গাইব।’ শ্যাম হাসলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, চল।’ শ্যামের হাত ধরে চট্টগ্রাম শহরে এলেন কল্যাণী। শুরু হলো গানের তালিম। একদিন শ্যামের বাসায় এলেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও মাইজভান্ডারি গানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল গফুর হালী। কল্যাণী গেয়ে শোনালেন কয়েকটি আঞ্চলিক গান। হালীর মনে ধরল। দিনে দিনে বাড়ল গুরু-শিষ্যের সখ্য। একদিন হালী নিজের লেখা মরমি গান তুলে দিলেন কল্যাণীর কণ্ঠে—‘দেখে যা রে মাইজভান্ডারে...’। মাইজভান্ডারি গান দারুণ খেলল তাঁর গলায়। হালী বললেন, ‘তুই, আঞ্চলিক গান গাইবি। তবে মাইজভান্ডারি গান বেশি করবি।’ গুরুর এমন স্বীকৃতিতে খুশিতে আটখানা কল্যাণী। এরপর ১৯৮২ সালের দিকে গ্রামোফোন রেকর্ডে বের হলো তাঁর প্রথম মাইজভান্ডারি গানের অ্যালবাম। এখনো মন মজে আছে এই মাইজভান্ডারি গানে। এ পর্যন্ত মাইজভান্ডারি গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে ৪০টির বেশি। মাইজভান্ডার দরবার থেকে খেতাবও জুটেছে—‘পাগলি’। কল্যাণী ঘোষ বলেন, ‘দরবারের অনেকে বলেন, “তোকে চিতায় নেওয়া যাবে না, কবর দিতে হবে।” এটা তাঁদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।’ কল্যাণী ঘোষ বিভিন্ন সময় গেয়েছেন রমেশ শীল, আসকর আলী পণ্ডিত, খাইরুজ্জামান পণ্ডিত ও সেকান্দর পণ্ডিতের গানও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রমেশ শীলের ‘দিন দুনিয়ার মালিক বাবা মাওলানা’, ‘আমার গাউসে ভান্ডারি’, ‘গাউসুল আজম বাবা নূরে আলম’, ‘নাগর বন্ধু শ্যাম’ ও ‘কত খেলা জানো রে মওলা’। আসকর আলী পণ্ডিতের ‘কী জ্বালা দি গেলা মোরে, ‘দেখি না দেখিল মোরে,’ ‘এক সের পাবি/ দেড় সের খাবি’ ও ‘কেউ রে ন বুঝায়ুম রে আঁর পরান বন্ধু কালা’। গফুর হালীর লেখা ও কল্যাণী ঘোষের গাওয়া বেশকিছু সাম্পানওয়ালার গানও শ্রেতাদের মুখে মুখে ফেরে। আঞ্চলিক গানেও কল্যাণী ঘোষের অ্যালবাম বেরিয়েছে ৩০টির বেশি। সুরের যুগলবন্দী মঞ্চের অন্তঃপ্রাণ এই শিল্পী ঘরও বেঁধেছেন মঞ্চের মানুষ তবলাবাদক অভিজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে। কীভাবে একসঙ্গে পথচলা? কল্যাণীর মুখে তখন লাজুক হাসি। মুখ খুললেন পাশে বসা অভিজিৎ। বললেন, ‘মঞ্চে একসঙ্গে পারফর্ম করা থেকে ভালো লাগার শুরু। একে অপরকে ভালো বুঝতে পারতাম। প্রায় সময় কল্যাণী কোন গানটি গাইবে, তা আমার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করত। ধীরে ধীরে আমার প্রতি নির্ভরতা বাড়তে থাকে তার। একসময় বুঝলাম ঘর বাঁধার সময় হলো। ব্যস, হয়ে গেল মালাবদল।’ এর মধ্যে কথায় যোগ দেন এই শিল্পী দম্পতির একমাত্র সন্তান মিঠুন চক্রবর্তী। সুরের এই উত্তরাধিকারীও হাঁটছেন একই পথে। ইতিমধ্যে নাম কুড়িয়েছেন পারকাশনিস্ট (বাদ্যযন্ত্রশিল্পী) হিসেবে। বাজিয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার, সংগীত পরিচালক ও শিল্পী এ আর রহমানের সঙ্গে। সেরা ড্রামার হিসেবে পুরস্কার জিতেছেন বিভিন্ন সময়। এখন সুরকার হিসেবে কাজ করছেন। তবে ছেলেকে আইনজ্ঞ বানাতে চেয়েছিলেন মা। এ জন্য লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছিলেন লন্ডনে। কিন্তু সুর যাঁর রক্তে তাঁর মন কি অন্য কোথাও বসে! লন্ডনে গিয়ে আইন পড়া বাদ দিয়ে ভর্তি হলেন টেক মিউজিক্যাল কলেজে। রয়েল একাডেমি অব মিউজিকের অর্কেস্ট্রাতেও বাজানোর সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তিন বছর পর দেশে এসে পুরোদস্তুর লেগে গেলেন সংগীতে। এখন মায়ের গান নতুন করে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করছেন তিনি। এসএ টিভিতে ধারাবাহিক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে মিঠুন বাজাবেন, গাইবেন কল্যাণী ঘোষ। ছেলেকে নিয়ে কল্যাণী এখন বেশ উচ্ছ্বসিত। তাঁর কাজে মুগ্ধ তিনি। মায়ের এমন স্বীকৃতিতে ছেলের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আর তাঁদের ছায়া দিয়ে আগলে নিচ্ছেন অভিজিৎ। সংগীতের পথে চলেছেন সুরের এই তিন সওয়ারি। একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৯-১০-০১৪:

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1