শিক্ষার আলোয় ভরা হাসিল গ্রাম
একুশে সংবাদ : কাউকে মাছ ধরে দিলে সে একবারেই সেটা খেয়ে ফেলবে। কিন্তু মাছ ধরার কৌশলটা শিখিয়ে দিলে বাকি জীবন নিজেই মাছ জোগাড় করে নিতে পারবে। শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারটাকে এভাবেই দেখেন মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম। যুক্তরাষ্ট্রফেরত প্রকৌশলী। চাকরিজীবন শেষ করে নিজ গ্রাম জামালপুর সদর উপজেলার হাসিলে ফিরে স্বপ্নের বিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন।
গোটা জেলায় সুপরিচিত হাসিল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি তিনি। শিক্ষকদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, কোনো ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা চলবে না। ক্লাসে না বুঝলে পরে আলাদা সময় নিয়ে শিক্ষার্থীকে পড়াতে হবে।
হাসিল চ্যারিটেবল ট্রাস্টের সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল ইসলামজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে হাসিল গ্রামে মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম অল্প কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ১৯৯৭ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করেন। টিনের চালাঘরটি দুই বছরের মধ্যেই ঝড়ে উড়ে যায়। এরপর নতুন উদ্যমে গড়লেন ইট-সিমেন্টের মজবুত ভবন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় নূরুল ইসলাম মনস্থির করেছিলেন, নিজ গ্রামে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়বেনই। অনুপ্রেরণা পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা এজরা কর্নেলের জীবনের গল্প থেকে।
হাসিল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এখন প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মোট ২ হাজার ১০০ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। প্রতিটি গণপরীক্ষায় এই প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে জামালপুরের সেরা। জেলা সদরে এই স্কুলের দুটি শাখা আছে। শিক্ষকসংখ্যা সব মিলিয়ে ১০৫। পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে হাসিল চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, যার সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম।
প্রবাসে চাকরির পেনশনের বেশ কিছু অর্থ খরচ করে তিনি এই প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। সরকার থেকে কোনো সাহায্য নেননি বা এমপিওভুক্তও করেননি। তাঁর বড় ভাই ডা. শামসুল হক পরে (২০০৩ সাল) এসে গ্রামবাসীর সেবায় যোগ দিয়েছেন। স্কুলের সামনেই একটি দাতব্য হাসপাতাল গড়েছেন। এতে রোগীরা বিনা মূল্যে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন। ছয় শয্যার অনুমোদন আছে। জামালপুরের চিকিৎসক মাহমুদুল হুদা এসে মাসে দুই দিন মোট ৬০ জনের চোখের ছানির অস্ত্রোপচার সম্পূর্ণ বিনা খরচে করে দেন। এ ছাড়া প্রতি মাসে হাসিল হাসপাতালে গড়ে ছয়-সাতটি অস্ত্রোপচার হয়।
এই স্কুল ও হাসপাতাল গত কয়েক বছরে গোটা এলাকার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তবে স্কুলটির তৎপরতা তুলনামূলক বেশি। স্কুলে আছে পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাব, মসজিদ, শহীদ মিনার, স্থায়ী মঞ্চ, বাগান, খেলার মাঠ ইত্যাদি। পুরো প্রতিষ্ঠানটি চলছে সরকারি কোনো সাহায্য ছাড়াই। প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম নিজের বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু অনুদান নিয়েছেন, তবে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নয়। শিক্ষকদের বেশির ভাগই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং বয়সে তরুণ। আবার তাঁদের মধ্যে ২৫ জন এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। কথা হলো স্কুলের প্রধান শিক্ষক একাব্বর আলী, জামালপুর সদরে বালিকা শাখার প্রধান শিক্ষক কামরুল হাসান, বালক শাখার প্রধান রেজাউল করিম ও তাঁর সহকারী সুজন আহমেদের সঙ্গে। হাসিল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে পাস করে তাঁদের জানামতে কেউ বেকার নেই।
মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম বললেন, ‘কোনো দিন টাকার পেছনে ছুটিনি। কিন্তু ভালো কাজের জন্য টাকা বরাবরই এসেছে। ভালো থাকতে চাইলে একটা মানুষের কত টাকা লাগে? খুব বেশি তো নয়। বাকিটা অপ্রয়োজনীয়। তাই ভালো কাজে সেটা খরচ করতে চাই।’
স্কুলের পাশেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এই দাতব্য হাসপাতালএই স্কুল থেকে এত এত ছেলে-মেয়ে পাস করে বেরোচ্ছে। একটা ছেলে বা মেয়ের উঠে যাওয়া মানে একটা পরিবারের উত্তরণ। বাকিদের সে টেনে তুলতে পারে। এ রকম চিন্তা থেকে এই ৭৪ বছর বয়সেও নিরলস কাজ করেন মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সাফল্য ও জীবনে প্রতিষ্ঠা দেখলে আবেগাপ্লুত হন। এ তো তাঁরই স্বপ্নপূরণ।
সরেজমিনে দেখা গেল, হাসিলে স্কুল, হাসপাতালসহ গোটা প্রাঙ্গণ নয় একর জায়গাজুড়ে। এর মধ্যে আছে পুকুর, বাগান, মাঠ, সবজিখেত, গাছগাছালি। পরিচ্ছন্নতা একেবারে নিখুঁত। শিক্ষকসহ সব কর্মী দুপুরে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পান। তাঁদের সন্তানেরা বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ পায়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কাজ করছেন শিক্ষক হাবিবুন নাহার। তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে চান। বাংলাদেশের সেরা স্কুল করতে চান। বললেন, এ বছর বেশ কয়েকটি ক্লাসে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার শুরু করেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান খান একাডেমি বাংলাদেশের ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। এগুলোর মধ্যে হাসিল স্কুলই ঢাকার বাইরের একমাত্র প্রতিষ্ঠান।
মেষ্টা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জামিনুর তালুকদার বলেন, হাসিল স্কুল অনেক ভালো করছে। গরিব-দুঃখী পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারছে। হাসপাতালেও মানসম্মত সেবা নিচ্ছে স্থানীয় লোকজন।
বিভিন্ন পরীক্ষায় কয়েক বছর ধরে শতভাগ পাসের নজির স্থাপন করে হাসিল স্কুল অ্যান্ড কলেজ জামালপুরে সেরা হয়ে উঠেছে। ইংরেজির শিক্ষক সুজন আহমেদ বললেন, এই হাসিল স্কুল না থাকলে তাঁর পড়াশোনাই হয়তো হতো না; শিক্ষকতা তো অনেক দূরের কথা। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা এই স্কুল দেখে প্রশংসা করে গেছেন। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এসেছিলেন। বিদেশি প্রশিক্ষকেরাও এসে কাজ করে গেছেন। অতিথিদের প্রশংসা তো বটেই, নূরুল ইসলামের এসব উদ্যোগ স্থানীয় মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছে।
একুশে সংবাদ // পপি // প্রআ // ১৭-০২-১৭
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :