AB Bank
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

কাঙালকথা...


Ekushey Sangbad

০২:০৮ পিএম, এপ্রিল ১৯, ২০১৫
কাঙালকথা...

একুশে সংবাদ : কুষ্টিয়ার কুমারখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরু পিচঢালা পথ চলে গেছে কুন্ডুপাড়ার দিকে। পাকা সড়ক ছেড়ে খানিকটা হেঁটে যেতে হয় সরু মেঠোপথ ধরে। সামনে একটু এগুলেই চোখে পড়বে দেয়ালের পলেস্তারায় আঁচড় কেটে লেখা ‘এমএন প্রেস’। দেয়াল ঘেড়া বাড়িটি এতটাই নাজুক যে, প্রথম দেখায় মনে হয়, যে কোনো সময় বুঝি হুড়মুড় করে ধসে পড়বে। চাল নড়বড়ে। বাঁশের খুঁটির ঠেস দিয়ে বারান্দা, ঘরের চাল আটকে রাখা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, আশপাশের পরিবেশ মনোরম। বাড়িতে থাকেন যে প্রৌঢ়, তিনিও বাড়িটির মতোই দীনহীন। নাম অশোক মজুমদার। পাঁচ পুরুষ ধরে তাদের এই বাড়িতে বসবাস। দর্শনার্থীরাও আসেন বাড়িটি দেখতে। পাঠক, এটিই গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ঊনবিংশ শতাব্দির আলোকিত ব্যক্তিত্ব কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়ি এবং প্রেস। এই প্রেসেই কাঙাল হরিনাথ ১৮৭৩ সালে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ছাপাতেন। এটি এখন ইতিহাসের অংশ। প্রেসটিতে যদিও মাকড়সার জাল আর ধুলার স্তর জমে আছে, তবু এখনো এটি ছাপার কাজের উপযোগী বলে জানালেন অশোক বাবু। তিনি হরিনাথ মজুমদারের প্রপৌত্র। প্রেসটি নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। তাই এখনো কুমারখালী গেলে প্রেসটি এক নজর দেখে আসার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না দর্শনার্থীরা। প্রাচীন বাংলার মুদ্রণ জগতের প্রথম ছাপাখানা বিখ্যাত এমএন প্রেসের বিবর্ণ অবস্থা দেখে ভীষণ কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছেন অনেক ঐতিহাসিকও। অথচ এই ট্রেডল মেশিনে ছাপা হওয়া ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে রেখেছিল বলিষ্ঠ প্রতিবাদী ভূমিকা। আজ তার আর কোনো জৌলুস নেই। হরিনাথ মজুমদারের উত্তরসুরীদের পারিবারিক জমি সংক্রান্ত কোন্দলে অমূল্য এ নিদর্শনটি ভাঙা ঘরের একপাশে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। মাথায় ছাদ নেই। রোদ-বৃষ্টি, ঝড় সব মাথার ওপর দিয়েই যাচ্ছে। কয়েকটি ভাঙা টিন আর পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে মেশিন।বছরখানেক আগেও এর অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের স্বপ্নের নাড়ি কুমারখালীর কুন্ডুপাড়ার মাটিতে পোঁতা। দীর্ঘ শতবর্ষ আগের কিছু স্মৃতিচিহ্ন তার বাস্তুভিটায় আজ খুঁজে পাওয়া বড়ই দুস্কর। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় সব নিদর্শনই আজ লুপ্ত। অথচ সরকারি উদ্যোগে এখানে অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘কাঙাল স্মৃতি কমপ্লেক্স’ ব্যাতীত কোনো প্রকল্প আজও বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও এখানে স্মৃতি বলতে অবশিষ্ট রয়েছে ঐতিহাসিক সেই ছাপার যন্ত্র হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পাণ্ডুলিপি। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য সহজেই কাঙালের জীবনকর্ম ও সঠিক ইতিহাস জানার পাশাপাশি তাকে নিয়ে গবেষণারও সুযোগ সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, এ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রও। হরিনাথ মজুমদারের জন্ম ১৮৩৩ সালে, মৃত্যু ১৮৯৬ সালে। অল্প বয়সেই তিনি পিতা-মাতাকে হারিয়েছিলেন। স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে পড়ালেখা শুরু। অনাথ হয়ে পড়ায় আর্থিক দুর্গতিতে পড়াশোনা বেশিদূর এগুতে পারেননি। তবে বিদ্যানুরাগ ছিল প্রবল। সমাজ-সচেতনতাও প্রখর। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ দেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা অন্যতম। স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজদের প্রজাপীড়ন দেখে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন হরিনাথ। ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সেই থেকে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামের মাসিক পত্রিকা। পরে এটি পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। গ্রামবার্ত্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্নের প্রেস থেকে। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে। ২৫ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। যন্ত্রটির মাঝখানে এর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনের তারিখ লেখা রয়েছে। লন্ডনের ১০ ফিন্সবারি স্ট্রিটের ক্লাইমার ডিক্সন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে কলম্বিয়ান প্রেস মডেলে ১৭০৬ নম্বর এ মুদ্রণযন্ত্রটি তৈরি করা হয় ১৮৬৭ সালে। প্রয়াত এডওয়ার্ড বিভান এ যন্ত্রটি পেটেন্ট করেন। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র বাংলা ১২৮০ সালের ১৭ শ্রাবণ সংখ্যায় কুমারখালীতে কাগজ ছাপা কল বসার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সে খবর লোকমুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অসংখ্য লোক দেখতে আসে কেমন করে কাগজের গায়ে অত ছোট লেখা হয়। ৩০-৩৫ মণ ওজনের ডাবল ক্রাউন সাইজের বিশাল মেশিন। দেখতে দানবের মতো! মেশিনে কাগজ ছাপাতে তিনজন লোক লাগত। মেশিন চলার সময় দেখা যেত মেশিনের মাথার ওপর ডানা প্রসারিত ঈগল পাখির মতো দুটো অংশ দুপাশে সরে গিয়ে যথাস্থানে ফিরে আসছে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা এ প্রেস দেখতে আসতেন। পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সেই কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর আরো কিছু জায়গায় কাজ করেছেন। কিন্তু কোথাও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠিতে স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়ত-প্রজার ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ নিজ চোখে দেখেন। কাঙালের জীবনীকার অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর মতে, এই শোষণের প্রতিকারের চিন্তা থেকেই তিনি ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা করেন। গণসংগীত শিল্পী কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস এক লেখায় উল্লেখ করেন : ‘রবীন্দ্রনাথের আগে ঠাকুর পরিবারের যেসব সদস্য জমিদার হিসেবে শিলাইদহে এসেছিলেন, তারা প্রজাবৎসল ছিলেন না। তাদের অত্যাচারের কথা হরিনাথ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় সাহসের সঙ্গে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রিয় বন্ধু কাঙালকে শায়েস্তা করতে পাঞ্জাবি লাঠিয়ালদের কলকাতা জাঁকিয়ে দিয়েছিলেন।’ পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে জমিদারেরা তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করে। তখন লালন সাঁই অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাকে রক্ষা করেছিলেন। এখানে পাঠকদের জানিয়ে রাখি, ফকির লালন সাঁইয়ের সঙ্গে হরিনাথের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এ ছাড়া ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্র কুমার রায়রা ছিলেন তার শিষ্যতুল্য এবং গ্রামবার্ত্তার লেখক। হরিনাথ নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক। ‘কাঙাল ফকির চাঁদ বাউল’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বহু গান লিখেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ১৮টি। এর মধ্যে তার রচিত ‘বিজয় বসন্ত’ উপন্যাসটি পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। এর ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তার জীবদ্দশাতেই। পূর্বপুরুষের আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে পারেননি অশোক মজুমদার। তিনি জানালেন, ১৯৭১ সালে প্রেসঘরটির ওপর পাকিস্তানি হানাদারেরা বোমা ফেলেছিল। যন্ত্রটি রক্ষা পেলেও ঘরের ছাদ, দেয়াল ভেঙে যায়। মেরামত করার সামর্থ্য নেই। তাই এখানেই মাথা গুঁজে আছেন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। ‘ডবল ক্রাউন’ সাইজের কাগজে এই মূদ্রণযন্ত্রটিতে সারা দিনে প্রায় এক হাজারটি ছাপ দেওয়া যায়। ‘যে যন্ত্রে কাঙালের হাতের স্পর্শ, লালনের হাতের স্পর্শ, মীর মোশাররফ, জলধর সেনের হাতের স্পর্শ, সেখানে আমি হাত রাখতি পারিছি, এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কি আছে’, বলছিলেন অশোক। সে কারণেই যন্ত্রটি বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন তিনি। অশোক বাবু জানালেন, কাঙাল হরিনাথের একটি গান সত্যজিৎ রায় ব্যবহার করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’তে। কিন্তু গানটি কার এ কথার উল্লেখ ছিল না ছবির পরিচিতি অংশে। পরে এ সম্পর্কে জেনে চিঠি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। খুব পরিচিত গান। ইন্দির ঠাকরুনের ভূমিকায় চুনীবালা গেয়েছিলেন গানটি ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার কর আমারে’।নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি বলে লোক শিক্ষার প্রতি হরিনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলকাতার বাইরে দূরে মফস্বলে সংস্কৃতিচর্চার একটি অনুকূল আবহাওয়া রচনা করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু উপার্জনের নির্দিষ্ট উৎস না থাকায় আর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশের জন্য চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রায় কাঙাল হয়ে পড়েন। ‘কাঙাল’ বলেই সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন হরিনাথ মজুমদার। তারপরও কৃষক-প্রজা, রায়ত শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসাবে প্রতিকাটি ২৫ বছর প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও কাঙাল তার প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। এলাকার সুধীজনদের অভিমত, আমাদের দেশে জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট বা সাংবাদিকতা বিভাগ রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি কাঙাল হরিনাথের প্রেসটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারে না? ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে কাঙাল হরিনাথ পরিষদের পক্ষ থেকে এর সভাপতি কামাল লোহানী এ ধরনের উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কাঙালের বংশধরদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাননি তিনি। হরিনাথ মজুমদারের প্রপৌত্র অশোক মজুমদারকে জিজ্ঞাসা করা হয়, জাদুঘর বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি প্রেসটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয় তাহলে তার কোনো আপত্তি আছে কিনা? তখন তিনি জবাব দেন, আমার বেনিফিট কোথায়? স্থানীয় জনসাধারণসহ সবার অভিমত, কাঙাল হরিনাথের এ প্রেস একটি জাতীয় ঐতিহ্য। জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে সম্পদটি ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। সে কারণেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এর সংরক্ষণ হওয়া উচিত। একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৯-০৪-০১৫:
Link copied!