AB Bank
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

বিশ্বব্যবস্থা ও বাংলাদেশের রাজনীতি


Ekushey Sangbad

১১:০৫ এএম, এপ্রিল ১৭, ২০১৫
বিশ্বব্যবস্থা ও বাংলাদেশের রাজনীতি

একুশে সংবাদ : বলা ভুল হবে না আমরা বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই বাস করি। ধারণা হিসেবে ‘বিশ্বব্যবস্থা’ অনেক ব্যাখ্যা দাবি করে। সে ব্যাখ্যায় এখানে যাব না। ধরে নেব বিশ্বব্যবস্থা বলতে কি বোঝাচ্ছে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা আছে। নিদেনপক্ষে এতটুকু আমরা বুঝি যে, গত কয়েক দশক ধরে অর্থনৈতিক সম্পর্কের গোলকায়ন ঘটেছে বিপুলভাবে, বিশ্ববাজার আগেও ছিল; কিন্তু গোলকায়নের মধ্য দিয়ে যে বিশ্ববাজার গড়ে উঠেছে কোনো সমাজ বা ব্যক্তি তার বাইরে থাকতে পারছে না। পুঁজিকে বিশ্ব-ঐতিহাসিক দাবি করে কার্ল মার্কস বলেছিলেন, পুঁজির পুঞ্জীভবন ও আত্মস্ফীতির শক্তি এত প্রবল যে, তার সামনে অন্য কোনো সম্পর্ক টিকবে না, সবই মোমের মতো গলে যাবে। আবিষ্কার ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে নানা ধরনের; তথ্য শ্রুতি, অক্ষর বা চিহ্নের চরিত্র থেকে তথ্য মুক্ত হয়ে ডিজিটাল হয়েছে, সংবাদাদি এখন ইন্টারনেটে বাইনার বাইট হয়ে ধেয়ে যেতে পারছে পলকে। মানবাধিকারকে সার্বজনীন গণ্য করা হচ্ছে এবং শক্তিশালী দেশগুলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বলতে এতকাল আমরা যা বুঝে এসেছি সেটা আর মানছে না। তার ফল বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য ভালো বলা যাবে না। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষার অজুহাতে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের আক্রমণ করছে। ক্ষমতা থেকে হত্যা করে সরিয়ে দিচ্ছে তাদের নেতাদের, যাদের তারা পছন্দ করে না। ধনী ও পরাক্রমশালী দেশগুলো যে নীতি, বিধান ও আইন ‘সার্বজনীন’ বলে গণ্য করে তাকে মান্য করেই এ বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে দুর্বল দেশগুলোকে টিকে থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির দিক থেকে বিশ্বব্যবস্থার মানে নিয়ে আমরা যথেষ্ট ভাবি সেটা দাবি করা যাবে না। বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করি অধিকাংশই মনে করেন বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা একটি বাস্তবতা, অতএব এর মানে নিয়ে ভাবার অর্থ এর ‘বাস্তবতা’ সম্পর্কে অবহিত হওয়া। সেটা তো অবশ্যই দরকার। কিন্তু আমাদের জন্য তার ‘মানে’ শুধু বাস্তবতা বিচার নয়, একে মোকাবিলা করার জায়গা থেকে বোঝা। সেটা নৈর্ব্যক্তিক নয়, বরং রাজনৈতিক। আমাদের রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সঙ্কল্পের জায়গা থেকে বোঝা। অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, সংস্কৃতিবিদ্যা ইত্যাদি সেই বাস্তবতা বোঝার জন্য কাজে লাগতে পারে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক সঙ্কল্পের জায়গা থেকে বিচার করার দরকার হয়ে পড়ে। আমাদের ইচ্ছা ও অনিচ্ছার বাইরে বিশ্বব্যবস্থার নিজের যে চলন ও চরিত্র তাকে নৈর্ব্যক্তিক বলা যায়, তাতে অসুবিধা নেই। সেইসব শাস্ত্রের সহায়তা দরকার হয় যেসব শাস্ত্র অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে অবজেকটিভ বা নৈর্ব্যক্তিকভাবে আমাদের বুঝতে সহায়তা করে বলে দাবি করে। শুধু সতর্ক থাকা দরকার যে, বিশ্বব্যবস্থার মানে স্রেফ বিশ্বব্যবস্থার নৈর্ব্যক্তিক ব্যাখ্যা নয়। বাংলাদেশের জনগণের অংশ হিসেবেও বিশ্বব্যবস্থার প্রতি আমাদের উপলব্ধিকে বোঝার দরকার আছে। এটা টের পাওয়া কঠিন নয় যে, বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশ বিশ্বব্যবস্থার অধীন, এ ব্যবস্থার অংশীদার নয়। বিশ্বব্যাপী যে যজ্ঞ চলছে সে যজ্ঞের বলয়ের মধ্যেই বাংলাদেশের অবস্থান। বলয়ের বাইরে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। কিন্তু যজ্ঞের পূজা কিংবা পৌরহিত্যে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর কোনো অধিকার নেই। তাদের স্থান মন্ডপের ভেতরে নয়, প্রান্তে কিংবা বাইরে। বিশ্বব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার বা নিজের স্বার্থের অনুকূলে রাখার ক্ষমতা না থাকাটা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য সব সময়ই হুমকি হয়ে আছে। এই প্রান্তিক উপলব্ধি কিংবা পরাধীনতার বোধ আমাদের মধ্যে নেই তা নয়। আছে। তবে সেটা এমন মাত্রার নয় যে, সেটা বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের পরাধীনতার চরিত্র নিয়ে আমাদের যথেষ্ট ভাবতে বাধ্য করে। ভাবা যে দরকার সেটাই তো সম্ভবত আমরা বোধ করি না। তবে আমাদের সমাজে গত দুই-তিন দশক ধরে যে রূপান্তর চলছে তাতে বিশ্বব্যবস্থার প্রতি সংবেদনশীল না হয়ে কোনো ফলপ্রসূ রাজনীতি গড়ে তোলা যাবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেই বলা যায়। বিশ্বব্যবস্থাকে স্রেফ নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিচার করতে চাইবার সংবেদনশীলতার কথা বলছি না। তাকে রাজনৈতিকতার দিক থেকে বিচার করার সংবেদনার কথা বলছি। পরাধীনতার বোধ যদি আদৌ বাংলাদেশে থাকে তাহলে বিশ্বব্যবস্থাকে সেই বোধের জায়গা থেকে বিচার করার ক্ষমতা অর্জনের নিরাপোস তাগিদই বিশ্বব্যবস্থার প্রতি রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা। কোনো বস্তু বা বিষয়কে আদৌ নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিচার সম্ভব কিনা সেটা পুরনো একটা তর্ক। কিন্তু তার পরও সমাজে কোনো বিষয় জানা ও বোঝার জন্য যে এলেম, বিজ্ঞান বা শাস্ত্র গড়ে ওঠে সেসব বিদ্যা নিজেদের জ্ঞানকা-ের পদ্ধতি ও সিদ্ধান্তকে সার্বজনীন প্রমাণ করতে গিয়ে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠার চেষ্টা চালায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে সার্বজনীন ও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠার তাগিদ স্বাভাবিক। এর মূল্য অনস্বীকার্য। বিশ্বব্যবস্থার প্রতি রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা সার্বজনীন ও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠার তাগিদকে অস্বীকার করে না; কিন্তু নিজ নিজ জ্ঞানকান্ডের ভূগোল, সীমা ও ইতিহাস সম্পর্কে বেহুঁশ হয়ে নয়। বিদ্যাচর্চা এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের সার্বজনীন ও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠার বাসনা এক ধরনের তাগিদ বা প্রবণতা। তার মূল্য প্রবণতা হিসেবে। মানুষের যে কোনো অভিজ্ঞতারই স্থানকালপাত্র এবং চিন্তার সুনির্দিষ্ট অনুমান ও প্রক্রিয়া রয়েছে। সেই সব ধারণ করেই বিদ্যা নিজেকে সার্বজনীন বা নৈর্ব্যক্তিক দাবি করে এই শর্তে যে, স্থানকালপাত্রের পার্থক্য এবং চিন্তার সুনির্দিষ্ট অনুমান ও প্রক্রিয়ার অধীনতা মানে বলেই বিদ্যার দাবি সঙ্গত। এই দিক থেকে বিশ্বব্যবস্থাকে অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব ও অন্যন্য শাস্ত্রের অধীনে এনে বিচারের সুফল আছে অবশ্যই। কিন্তু তার সীমা সম্পর্কে সতর্ক থাকা জরুরি। এই সতর্কতা জারি রেখে বাংলাদেশের মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে ও সামাজিক বা সামষ্টিক উপলব্ধির জায়গা থেকে বিশ্বব্যবস্থার মানে বোঝার চেষ্টা করা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ। দুই বিশ্বব্যবস্থার প্রসঙ্গ তুলছি কেন? বাংলাদেশে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের যে অবস্থা তার রূপান্তর ঘটাতে হলে বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে ভাবা ও বোঝা জরুরি। কিন্তু সে বোঝাবুঝিকে রাজনৈতিক হতে হবে। রাজনৈতিক হতে হলে কিছু বিষয় শুরুতেই স্পষ্ট হওয়া দরকার। কিন্তু যে সমাজ বা সমষ্টির কথা ভেবে এই রাজনৈতিকতার নির্ণয় দরকার, তারা কারা? সহজ ভাষায় বোঝানোর জন্য আমরা প্রশ্নটি এভাবে তুলতে পারি যে, আমরা যখন নিজেদের ‘আমরা’ বলি, সেই সমষ্টির মধ্যে কাদের আমরা অন্তর্ভুক্ত করি? যখন আমরা বলি বিশ্বব্যবস্থার আমরা নিয়ন্তা নই এর পরাধীনতা মেনেই আমাদের টিকে থাকতে হচ্ছে, এই ‘আমরা’ কারা। বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে পরাধীন অবস্থা থেকে শক্তির অবস্থানে যাদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা আমরা বলি সেই আমরা কীভাবে গঠিত হব? তার জন্য কী আমাদের কর্তব্য? আমরা আসলে কারা? ইত্যাদি। বিশ্বব্যবস্থাকে জানা, বোঝা ও মোকাবিলা এই ‘আমরা’কে নিয়েই। তাহলে বাংলাদেশের নতুন রাজনীতির উদ্ভব কেবল তখনই সম্ভব যখন এই ‘আমরা’ সম্পর্কে মোটামুটি একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠবে। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যবস্থাকে জানা বা বোঝার আগেই এই আমরাকে আমাদের আগাম উপলব্ধি করতে হচ্ছে। এই অনুমান অন্যায় নয় যে, বাংলাদেশের সব নাগরিককে নিয়েই আমাদের ভাবতে শিখতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে কি শ্রেণী, সম্পদের মালিকানা, লিঙ্গ, ধর্ম, বিশ্বাস, রাজনৈতিক মতাদর্শ, দল, গোষ্ঠী ইত্যাদির ভেদ নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের জনগণের যে রাজনৈতিক পরিচয় সেটা তার ভিন্নতা নিয়ে নয়, তার সামষ্টিকতা নিয়ে। সেই সামষ্টিকতা আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। রাষ্ট্রের এ উপস্থিতি এবং বিশ্বের রাষ্ট্র সভায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয় সুনির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। বিশ্বব্যবস্থা কথাটির গুরুত্ব যদি আমরা বুঝি তাহলে বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যা তীক্ষ্ন ভাবে সদা সর্বদা নজরে রাখা দরকার। এই দিকটা বুঝতে পারলে আমরা সহজেই একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমাদের পার্থক্যের ভিন্নতা এমন কোনো বিরোধ বা সংঘর্ষের জন্ম দেবে না, যা বিশ্ব রাষ্ট্র সভায় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, বাংলাদেশ নামে যে রাজনৈতিক বলয় বর্তমান তাকে অক্ষুণ্ন রাখতে হলে ভিন্নতা ও পার্থক্যের দাগ কতটুকু টানা উচিত, কত গভীরভাবে টানলে সেটা বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতি হয়ে ওঠে, বাংলাদেশকে স্থিতিশীল রাখে না, বিলোপের সম্ভাবনা তৈরি করে ইত্যাদি। যদি বিদ্বান রাজনৈতিকতার বলে আমরা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিভাজনের মীমাংসা করতে চাই তাহলে ভিন্নতা থেকে জাত নিজ নিজ আত্মপরিচয়ের সীমা সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই সাবধান হতে হবে। আমি মনে করি না রাজনৈতিকতার বলয় চিরদিন একরকম থাকবে বা থাকাটা নৈতিক দিক থেকে বাধ্যতামূলক। আমরা নীতি নিয়ে আলোচনা করছি না, আলোচনা করছি রাজনৈতিকতা, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ও রাজনীতি নিয়ে। আমরা আত্মপরিচয়মূলক রাজনৈতিকতাকে পরিহার করছি। যে পরিচয়ের তীব্রতার কারণ বাংলাদেশের সমাজের প্রধান দুই পক্ষের মধ্যে এক দল নিজেদের ‘বাঙালি’ এবং আরেক পক্ষ নিজেদের ‘মুসলমান’ বলে পরিচয় দেয়। আত্মপরিচয়ের রাজনীতি বিভেদ ও বিভাজনকে যে মাত্রায় তীব্র করে তুলেছে সেই মাত্রা থেকে নিচে নেমে আসা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। রাজনীতির ইতিহাস ও বিবর্তনের দিক থেকে দেখলে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা এক সময় ইংরেজ শাসিত অবিভক্ত ভারতে ইংরেজের অধীনে ছিলাম, এরপর পাকিস্তান এবং এখন নিজেদের ‘বাঙালি’ জাতি দাবি করে বাংলাদেশ গঠন করেছি। আমরা বড় থেকে ছোট এবং ছোট থেকে ক্ষুদ্র হয়েছি। আরও ক্ষুদ্র হয়ে পড়ব কিনা সেটা আমাদের ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি সম্ভাবনা বিরাজ করছে- এক. বাঙালি ও মুসলমান এ দ্বন্দ্বের কারণে সমাজে বিভেদ, বিভাজন, হানাহানি ও রক্তপাত বেড়েছে। এ বিভেদ জারি থাকলে বাংলাদেশ একটি দুর্বল ও পরাধীন দেশ হিসেবে ধুঁকে ধুঁকে চলবে। কারণ এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে নিজের জন্য কোনো ধরনের শক্তিশালী অবস্থান অর্জন বা আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে সুবিধা আদায় করে নেয়া অসম্ভব। বাংলাদেশ হবে সস্তা শ্রম বা মজুরি দাসদের দেশ। যাদের আয়ে একটি ছোট অতি ধনী গোষ্ঠী টিকে থাকবে। কিন্তু দেশটি অপরিণামদর্শী জনগণ ও আন্তর্জাতিক পুঁজির জন্য সস্তা মজুরদের বন্দিখানা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠবে। দুই. বাংলাদেশে এই বিভেদ ও বিভাজনের আত্মঘাতী পথ পরিহার করার সঙ্কল্প বিশেষত তরুণদের মধ্যে বাড়বে। রাজনৈতিকতার মর্মকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধির চেষ্টা তারা করবে। এর অর্থ হচ্ছে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগত বিভিন্নতা নিয়েও নিজেদের একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা এবং পরস্পরের প্রতি সব ধরনের জুলুম প্রতিহত করে নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত করে তোলার ক্ষমতা অর্জন। এ ক্ষেত্রে ‘জুলুম’ কথাটি আমি তার গভীর অথচ বিস্তৃত রাজনৈতিক তাৎপর্যে ব্যবহার করছি। যেমন- শ্রেণী শোষণ অবশ্যই অর্থনৈতিক জুলুম; কিন্তু তাকে যদি শুধু অর্থনৈতিকভাবে কেবল অর্থনৈতিক ক্যাটাগরি হিসেবে বুঝি তাহলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জুলুম আড়াল হয়ে যায়। আরেকটি উদাহরণ, নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক ভিন্নতা রয়েছে, যা না থাকলে মানুষ প্রজাতি হিসেবে দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারত না। কিন্তু নারী-পুরুষ ভিন্নতা যদি ক্ষমতা ও অন্যায় অধিকারের ভেদে পরিণত হয়, যা পুরুষতন্ত্র নামে পরিচিত, তাহলে নারীর ওপর জুলুম আর সমাজের চোখে পড়ে না। একইভাবে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুর ওপর জুলুমের নিজস্ব চরিত্র আছে, তাকে নির্দিষ্টভাবে বোঝা ও সমাধান বাংলদেশকে একটি অবিভাজ্য রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এ কারণে আমি জাতিবাদী পরিচয় পরিহার করে বাংলাদেশের জনগণকে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করার পক্ষপাতী। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং বাংলা তাদের ভাষা। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নিবিড়। বাংলাদেশের টিকে থাকার অর্থ এ নিবিড়তা স্বাভাবিক গতিতেই গভীর হতে থাকা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিজেকে যেভাবে ইসলামের বিপরীতে হাজির করে তা আমাদের বিকাশের জন্য অনুকূল নয়। একইভাবে মুসলিম জাতীয়তাবাদও যেভাবে ইসলামকে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির বিপরীতে স্থাপন করে, তাতে বিভাজন ও বিভক্তি বাড়ে। বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের জন্য শক্ত অবস্থান আদায় করে নেয়ার জন্য দুটির কোনোটিই অনুকূল নয়। যতদূর জানি, বাংলা ভাষায় কথা বলেন এমন মানুষের মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাই অধিক। অতএব আমরা চাই বা না চাই, ইসলাম বাংলাভাষীদের রাজনৈতিকতা নির্ণয়ে নির্ধারক ভূমিকা রাখবে। আমি বাংলাদেশের কথা বলছি না, বিশ্বব্যবস্থার আলোকে সব বাংলাভাষীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিচার করে কথা বলছি। কিন্তু এ সম্ভাবনার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ওপর। যদি তারা ইসলামকে একটি জাতিবাদী আদর্শ ও তাদের রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের একমাত্র নির্ণায়ক হিসেবে হাজির করেন, ভাষা, সংস্কৃতি ও স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিজেদের চর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা করে তাহলে বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ সঙ্কীর্ণ কানাগলিতে আটকে যাবে। বিভাজন ও বিভেদের রাজনীতি আরও কঠিন হয়ে উঠবে। অথচ বাংলাদেশীদের পক্ষেই ইসলামের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মর্মের বিকাশ দ্রুততর করা সম্ভব, যাতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা বিশ্বব্যবস্থায় শক্তভাবে দাঁড়াতে পারি। আমার ধারণা, বাংলাদেশে দূরদর্শী চিন্তা ও রাজনীতি আসন্ন। বর্তমানের সঙ্কট ও দুর্দশা সাময়িক। বাংলাদেশ এ পর্যায় দ্রুতই অতিক্রম করে যাবে। ফরহাদ মজহার : কবি ও দার্শনিক একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৭-০৪-০১৫:
Link copied!